মোঃ মনজুর এলাহী তপনঃ বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের ও অনন্য। আমরা একটি অভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি ছাড়াও যৌথ ইতিহাস, যৌথ ভৌগোলিক অবস্থানের মাধ্যমে সংযুক্ত। আমরা উভয়েই পারস্পরিক বিশ্বাস ও বোঝাপড়া এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর ভিত্তি করে একটি সম্পর্কের সন্ধান করি ও সেটাকে মূল্য দিই। আমাদের জনগণের মধ্যে এক সুগভীর যৌথ সহানুভূতি রয়েছে, যার অনেকটাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত। এটিকে যেভাবেই বর্ণনা করা হোক না কেন, এটি একটি জনগণ-কেন্দ্রিক সম্পর্ক। আমাদের সম্পর্ককে জনগণ ও জনমত যে মাত্রায় প্রভাবিত করে, তা আমরা অনেক সময় ধারণা করতে পারি না।
একটি প্রতিবেশী দেশ হিসেবে, যাদের সাথে আমাদের সম্পর্কের প্রতি আমরা দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করি, বাংলাদেশের সাথে আমাদের বন্ধন শক্তি লাভ করে এই বিশ্বাস থেকে যে আমাদের শান্তি, নিরাপত্তা, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি পরস্পরের সাথে সংযুক্ত। এবং তাই, আমরা বহুমুখী সহযোগিতার একটি দৃঢ় কাঠামোর মাধ্যমে পারস্পরিক সমৃদ্ধিতে অভিন্ন অংশীদারত্ব সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা চালাই। উভয় দেশই বঙ্গোপসাগরের শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন। আমাদের রয়েছে একটি অভিন্ন জীবজগৎ ও বাস্তুসংস্থানীয় পরিবেশ, যা পরিবেশগত স্থায়িত্ব ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো যৌথ প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলায় আমাদের সহযোগিতাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
ভৌগোলিক অবস্থান, সক্ষমতা ও ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক আর বৈশ্বিক উচ্চাকাক্সক্ষার কারণে বাংলাদেশ কেবল আমাদের “নেইবারহুড ফার্স্ট” নীতির একটি স্তম্ভই নয়, বরং এটি ভারতের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান দৃষ্টিভঙ্গিসমূহের সংযোগস্থলে অবস্থান করছে- যেমন ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’, সাগর মতবাদ (সিকিউরিটি অ্যান্ড গ্রৌথ ফর অল ইন রিজিয়ন), এবং আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক দর্শন।
আমাদের বিশ্বাস, এটি শুধু আমাদের দুই দেশের জন্য নয়, বরং পুরো অঞ্চলের জন্যও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, কারণ আমাদের ক্রমবর্ধমান সক্ষমতা ও পরস্পরের শক্তি ও পরিপূরকতাসমূহ কাজে লাগিয়ে আরও সংযুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। বাংলাদেশ বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল, টেকনিকাল এন্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন (বিমসটেক) – এর অধীনে সংহতি এজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনন্যভাবে অবস্থান করছে, কারণ এটি এই অঞ্চলের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং বিমসটেকের প্রধান কার্যালয়ের স্বাগতিক দেশ হিসেবেও ভূমিকা পালন করছে।
আমাদের সম্পর্কের মধ্যে যে অনেক রূপান্তরমূলক পরিবর্তন ঘটেছে এবং যা এই অঞ্চলের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করেছে, সেগুলো একে অপরের উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষার প্রতি আমরা যে পারস্পরিক সংবেদনশীলতা দেখিয়েছি তার ফল। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের “জিরো-টলারেন্স” নীতি ও ভারতকে লক্ষ্যবস্তুকারী বিদ্রোহীদের আশ্রয় না দেওয়ার দৃঢ় সংকল্প আমাদের সহযোগিতা ও সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি ভবিষ্যতে আমাদের দুই দেশ, আমাদের অঞ্চল ও আমাদের সম্পর্কের উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে থাকবে।
আমাদের অন্যতম বড় সাফল্য – আমাদের সমুদ্র ও স্থল সীমানার সমাধান, যা আমাদের স্থল ও সমুদ্র সংযোগের পাশাপাশি সুনীল অর্থনীতিতে (ব্লু-ইকোনমি) সহযোগিতার ক্ষেত্রে অনেক সুযোগ উন্মুক্ত করেছে। পার্মানেন্ট কোর্ট অফ আরবিট্রেশন-এ বিষয়টি উপস্থাপন করে আমাদের সমুদ্রসীমা সমাধান এবং তারপরে সেটার রায় মেনে চলাটা হলো গণতান্ত্রিক ও নীতিনির্ধারিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি আমরা যে দৃঢ় বিশ্বাসী এবং তা আমাদের দ্বিপাক্ষিক আচরণে প্রতিফলিত হওয়ার একটি চমৎকার উদাহরণ।
আমাদের বহুমুখী অংশীদারত্বের রূপান্তরের একটি মূল প্রকাশ, যা আমাদের উভয় দেশের জনগণকে সরাসরি উপকৃত করেছে, তা হলো আমাদের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা, এবং আমাদের সংযোগ লিংকসমূহ।
আজ, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক ও বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তম অংশীদার। সাফটা-এর আওতায় ভারত একপাক্ষিকভাবে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশকে সব ধরনের পণ্যের জন্য শুল্ক-মুক্ত, কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে, যা বাংলাদেশ থেকে ভারতে বৃহত্তর রপ্তানি সক্ষম করেছে।
আমরা প্রায়ই বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি সম্পর্কে উদ্বেগ শুনে থাকি, তবে এটি উপলব্ধি করাটা গুরুত্বপূর্ণ যে, ভারত কর্তৃক বাংলাদেশে রপ্তানির অধিকাংশই বাংলাদেশের রপ্তানির একটি বড় অংশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বা প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ হিসেবে কাজ করে, যা বাংলাদেশকে মুদ্রাস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় সাহায্য করে।
প্রকৃতপক্ষে, একটি কম প্রশংসিত বাস্তবতা হলো, ভারত এখন সমগ্র এশিয়ায় বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজারগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে গত কয়েক বছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি সর্বদা ২ বিলিয়ন ডলারের আশেপাশেই রয়েছে। এবং আমরা চাই এই সংখ্যাটা বৃদ্ধি পাক।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সংযোগ এক একটি প্রধান সহায়ক যা আমাদের সমাজ, আমাদের ব্যবসায় ও আমাদের জনগণকে একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত হতে ও পরস্পরের মাধ্যমে উপকৃত হতে সহায়তা করে। এবং আমরা এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধন করেছি। লেখকঃ মনজুর এলাহী তপন/ সাংবাদিক।
Leave a Reply