মীর হোসেন মোল্লাঃ মাদক একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশেও মাদকাসক্তি পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেজনক। বর্তমানে সামাজিক অবক্ষয় ও ছোট-বড় প্রায় সব অপরাধের পেছনে অন্যতম প্রধান অনুঘটকের কাজ করছে মাদকাসক্তি। বর্তমান বাংলাদেশের বড় অংশের জনগোষ্ঠী কিশোর-তরুণ, যে কারণে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীকে বলা হয় ইয়ুথ ডিভিডেন্ট। ইউএনডিপি- এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বা এর নিচে। অর্থাৎ ৪৯ শতাংশ জনগোষ্ঠী বয়সে তরুণ। দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১০ কোটি ৫৬ লাখ। মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ কর্মক্ষম। তাই তরুণ জনগোষ্ঠীকে মাদকদ্রব্য ব্যবহার থেকে বিরত রাখা অত্যন্ত জরুরি।
দেশে প্রায় ৭৫ লাখের বেশি মানুষ মাদকাসক্ত রয়েছে। মাদকাসক্তের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ তরুণ-কিশোর (মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর)। গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯৮ শতাংশ ধূমপায়ী এবং তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ বিভিন্ন অপরাধ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা মাদক দ্রব্য সেবন করে তারা প্রথমে ধূমপানে অভ্যস্ত হয়, তারপর মাদকদ্রব্য সেবন শুরু করে থাকে। পরবর্তীকালে তারা গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, সিসা, হেরোইন, কোকেনসহ বিভিন্ন মরণনেশায় আসক্ত হয়।
মাদকাসক্তি—যাকে বলা হয় সকল সন্ত্রাস ও অপরাধের জনক। একজন মানুষ যখন অন্ধকারের ভুবনে পা বাড়ায় তখন সে প্রথম সিঁড়ির যে ধাপটিতে পা রাখে তা মাদকদ্রব্য। এই মাদকদ্রব্য তাকে টেনে নেয়, উৎসাহিত করে পরবর্তী ধাপগুলো পেরিয়ে যেতে। যুক্তরাষ্ট্রে ১২ বছর তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৮ হাজার মানুষের মধ্যে পরিচালিত জাতীয় একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, যারা ধূমপান করে বা করেছে তাদের হেরোইন সেবনের প্রবণতা ১৬ গুণ বেশি, গাঁজা ও কোকেন সেবনের প্রবণতা সাত গুণ বেশি। ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের মাদক ব্যবসায় ও প্রাপ্তির সহজলভ্যতা বেশি এবং বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তরুণ সমাজ এদিকে ঝুঁকেছেও বেশি—ঠিক যেমনটি প্রত্যাশা মাদক ব্যবসায়ীদের। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে মাদকসেবীর সংখ্যা অন্তত দেড় কোটি। এর মধ্যে রয়েছে ১ কোটি মাদকাসক্ত। একটি সময় ছিল যখন সমাজের বিত্তশালী পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এর আসক্তি ছিল, কিন্তু বর্তমানে তা ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। মাদকের নেশা এখন আলো ঝলমল নগরীর প্রাণকেন্দ্র থেকে শুরু করে অন্ধকার গ্রামেও এর অবাধ বিচরণ।
বন্ধুদের প্ররোচনায় অনেকে মাদক সেবন শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে এর একটি বিরাট অংশ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। নিষিদ্ধ বস্ত্তর প্রতি একশ্রেণির মানুষের আগ্রহ বেশি থাকে। ফলে এসব নেশাজাত দ্রব্যের চোরাচালান, অবৈধ ব্যবসায় বেড়ে যায়। অবৈধ ব্যবসায় করে হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ছে কতিপয় অসাধু চক্র। অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানিতে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এতে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তা ছাড়া মাদক কেনার অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে কিশোর-তরুণেরা ব্যাপকভাবে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এ সুযোগে মাদক ব্যবসায়ী, সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্র খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজিসহ নানা কাজে তাদের ব্যবহার করতে থাকে। মাদকের এই নেশার জালে একবার জড়িয়ে পড়লে কেউ আর সহজে এ জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। ফলে মাদকসেবীরা দিনে দিনে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আমাদের দেশে কিশোর সন্ত্রাসীর ক্রমবর্ধমান দাপটের যে তথ্য সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তার মূল কারণ সম্ভবত নিহিত রয়েছে এখানেই। দেশের সর্বত্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের নানাভাবে উৎত্যক্ত করা, গুলি বা ছুরিকাঘাতে হত্যা করা কিংবা সড়ক দুর্ঘটনার আধিক্যের পেছনেও মাদকাসক্তির ভূঁমিকা অন্যতম।
মাদক নির্ভরশীল ব্যক্তিকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে না পারলে যে কোনো সময় তার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। মাদকাসক্তি চিকিৎসায় ব্যক্তির নিজ ও তার পরিবারের সার্বিক সহযোগিতাসহ সেবা প্রদানকারী সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভালো করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। তবে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই, আমাদের এই সচেতনতা এবং সহযোগিতা যুব সমাজকে যুবশক্তিতে পরিণত করবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মাদক কি আমাদের সমাজের সব পরিবারেই ঢুকে পড়ছে? নাকি আমরা আমাদের সন্তানদের সঠিকভাবে পরিচালিত করতে পারছি না? এই দায়ভার কারা নেবে? পরিবার, সমাজ, না দেশ? আসুন না, মাদকের বিরুদ্ধে আমরা সবাই এক হই। অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে আমরা সবাই দল, মত, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে সবাই হাতে হাত ধরে কাজ করি। সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে ও স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য তরুণদের মাদকসহ সকল নেশা থেকে দূরে রাখতেই হবে। এ কিশোর-তরুণদের নেশা থেকে দূরে রাখতে পারলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ে তোলার কাজ ত্বরান্বিত হবে। সুতরাং, আমাদের আগামী প্রজন্মকে রক্ষার জন্য মাদক নিয়ন্ত্রণে সবাইকে সক্রিয় হতে হবে। শিশু-কিশোর-তরুণেরা, যারা আগামী দিনের ভবিষ্যত্ তারা মাদকের মাধ্যমে নেশার জগতে প্রবেশ করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াক—এটা কারো কাম্য হতে পারে না। লেখকঃ মীর হোসেন মোল্লা/ সাংবাদিক।
Leave a Reply