ফারুক আহমেদ পৃথ্বীঃ বলতে বলতে শেষ হতে যাচ্ছে একটি বছর। নতুন আরেকটি বছর শুরু হতে যাচ্ছে ২০২৫। বিগত বছরের অনেক কথা, ঘটনা, ইতিহাস, ভালো-মন্দ ঘটে যাওয়া অনেক কিছু ছিল স্মৃতি হিসেবে। অতীত ইতিহাসের একটি বছর বাংলাদেশের জনগণের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ইতিহাস হয়ে থাকবে নানা ঘটনার পরিসমাপ্তি। মানুষের সুখ-দুঃখ, শান্তি-অশান্তি, পারিবারিক-সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নানা ঘটনায় জর্জরিত ছিল বাঙালি জাতির জন্য ২০২৩ সাল। মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচার, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন, সংগ্রাম, মিছিল-মিটিং, অবরোধের বছর ছিল বাঙালি জাতির জন্য ২০২৪ সাল। ছাত্রদের মধ্যে হতাশা, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে নানা ধরনের টেনশন আর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নানা স্বপ্ন তাদের জীবনে এক অস্থির সময় তৈরি করেছে ২০২৪ সাল।
রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালে বহু ঘটনা দেশের জমিনে সংঘটিত হয়েছে। অপহরণ মামলা-হামলা, গুম, খুন হয়েছে বহু নিরীহ পরিবারের সদস্য। রাজনৈতিক কারণে ঘরবাড়ি ছাড়া, এলাকা ছাড়তে হয়েছে অনেক কর্মীকে। মামলার কারণে অনেককেই ঠিকানা বিহীন জীবনযাপন করতে শোনা যাচ্ছে। গোটা বছরটি ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন, সংগ্রাম আর জনজীবনে অস্থির একটি পরিবেশ। পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। প্রশাসনিক সব সেক্টরে জনভোগান্তি, হয়রানি জনগণের নিত্যসঙ্গী ছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেই অতীতের পড়ালেখার আদর্শিক সব সিলেবাস পরিবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার বারোটা বাজিয়েছে স্বৈরাচারী হাসিনা। শিক্ষার্থীরা আগেকার যুগে যেভাবে লেখাপড়া করত, পাঠ্যপুস্তকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এখন আর বই-পুস্তকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর সেই ভালোবাসা নেই বলা চলে। কারণ স্কুল-বিদ্যালয়ে সেই বইপুস্তক থেকে গণিতের অঙ্ক, ইংরেজির বাক্য, গল্প তৈরি, রচনা শিক্ষার পড়ালেখা হয় না। আজকের স্কুল শিক্ষায় ছাত্রদের শেখানো হচ্ছে সংস্কৃতির নামে বিজাতীয় সংস্কৃতি। শিক্ষার নামে রান্নাবান্না তৈরির প্র্যাকটিস। আদর্শিক শিক্ষার পরিবর্তে অনৈতিক শিক্ষা। ক্রমেই এগিয়ে চলছে। পোশাক-আশাক বেশভূষার পরিবর্তন এলেও শিক্ষার মাধ্যমে আলোকিত শিক্ষার্থী আদর্শিক নাগরিক নৈতিক শিক্ষার কারিগর শিক্ষক থেকে শিক্ষার্থী পর্যন্ত ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি জাতীয় জীবনে নানা অবক্ষয়, দুর্নীতি, লুটপাট; রাজনীতিতে সহিংসতা, শিষ্টাচারবহির্ভূত রাজনৈতিক কালচার বৃদ্ধি পেয়েছিল। জাতীয়ভাবে শৃঙ্খলা পরিবার থেকে রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে ক্রমেই জাতি হারিয়ে ফেলেছে। শিক্ষিত বিশিষ্টজনদের অভিমত এভাবে একটি জাতি মোটেও টিকে থাকতে পারে না। জাতির মেধা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, গবেষণা এসব বিষয়কে যদি গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রতিষ্ঠিত করা না হয়, তাহলে একটি জাতি ধ্বংস হওয়ার জন্য আর বেশি কিছু প্রয়োজন পড়ে না। ইংরেজি নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে বিদায় বছরকে মূল্যায়ন করে বলতে গেলে আমাদের জাতীয় চরিত্রের পরিবর্তন করতে হবে। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে পরিবর্তন করতে না পারলে এ জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নয়। শুধু দিন, মাস আর বছর গণনা করলে হবে না। আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে জনকল্যাণ, মানবকল্যাণ, মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার কী পর্যন্ত আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি, সেই জায়গাতে জাতীয়ভাবে জাতীয় নেতৃত্বকে হিসাব করতে হবে। শুধু উন্নয়ন, নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠার নাম শিক্ষা অগ্রগতি আর জাতীয় উন্নতি বলা চলে না। জাতীয় উন্নতির জন্য জাতীয়ভাবে নাগরিক চরিত্র, নাগরিক আদর্শ, মূল্যবোধ, দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্রীয় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলতে হবে। লেখকঃ ফারুক আহমেদ পৃথ্বী/ কলামিস্ট ও গবেষক।
Leave a Reply