মীর হোসেন মোল্লা(আরমান)
সত্য, সচেতন কিংবা অসচেতনভাবে শিশুকে আমরা নানা ধরনের খাবারের প্রতি অভ্যস্ত করে তুলছি, যা পুষ্টিকর তো নয়ই, বরং অনেক ক্ষেত্রে শিশুর স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। তাছাড়া আমরা কী খাচ্ছি? কী খাওয়াচ্ছি? আপনি আদর করে আমার পাতে কী তুলে দিচ্ছেন? এক কথায় উত্তর হচ্ছে ভেজালযুক্ত খাবার। ভেজালযুক্ত খাদ্য থেকে আমি-আপনি মুক্তি চাইলেও যেন কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছি না। তবে একদিনে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, অসাধু ও অতি মুনাফালোভী ব্যক্তিদের ফলে মূলত এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সুস্থ-সবল জাতি গঠন এবং সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলাদেশ গড়তে হলে নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই। শিশুরা যদি স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার না খায়, তাহলে তারা ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে না, বরং কোনো রকমে বেঁচে থাকে। এ কারণেই ‘কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড’ বা শিশুর অধিকারবিষয়ক সনদে ঘোষণা করা হয়েছে, প্রতিটি শিশুরই স্বাস্থ্যকর খাবার ও পুষ্টি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। প্রকৃতি থেকে আহরিত খাদ্যের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু অধিক মুনাফার আশায় অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের বিবেক বিসর্জন দিয়ে খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে, মাছ থেকে শুরু করে ফলমূল, চিপস, শিশুখাদ্য, জুস সব খানেই ভেজালের ছড়াছড়ি। নিরাপদ খাবার যেন কোথাও নেই। শিশুর বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, শিশুকে নিয়ে বাইরে গেলে পরিচিত কোনো একজন তার হাতে একটা চিপস কিংবা চকোলেট ধরিয়ে দিচ্ছে। আবার আমরাও অনেকে দীর্ঘ সময় পর বাইরে থেকে ঘরে ফিরলে শিশুর জন্য চকোলেট বা এ-জাতীয় খাবার নিয়ে আসি। এমনকি আত্মীয়-স্বজনও শিশুর জন্য বিস্কুট, চানাচুর, চকোলেট, আইসক্রিম আনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এতে শিশু মহাখুশি হচ্ছে। কিন্তু এভাবে তার স্বাস্থ্যগত কী পরিমাণ ক্ষতি করছি, তা বলা বাহুল্য। শুধু কী চকোলেট, চিপসের সমস্যা। সমস্যা রয়েছে সব জায়গায়। শহর কিংবা গ্রামের স্কুলের গেটে অনিরাপদ খাদ্যের সমারোহ থাকে। এসব খাদ্য খোলা থাকে। খাবারে ধুলাবালি পড়ে এবং মাছিসহ নানা ধরনের জীবাণুর সংমিশ্রণ ঘটে এসব খাবারের সঙ্গে। দুঃখজনকভাবে শিশুদের কাছে এটি প্রিয় খাবার। কোনো ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় না খাবারগুলো শিশুদের জন্য খাদ্যোপযোগী করে পরিবেশন করতে।এসব আমাদের জানা-বোঝার বাইরে নয়। কিন্তু তার পরও এসব খাবার কিনতে ও খেতে হয়। স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে ও অন্যের বিনা প্ররোচনায় আমরা ধীরে ধীরে আত্মঘাতী পথ বেছে নিই। আমাদের খাদ্য আদালত আছে, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আছে, খাদ্য পরীক্ষাগার আছে, খাদ্য বিশ্লেষক আছে, খাদ্য পরিদর্শক ও পরিষদ আছে, আছে ফৌজদারি কার্যবিধি এমনকি দণ্ডবিধিও। কিন্তু সবার ওপরে যা আছে তা হলো খাদ্য ব্যবসা ও ভেজাল খাদ্য—এসবই ওই আইনের শব্দযুগল। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সবকিছুর ওপর খাদ্য ব্যবসায়ীদের নকল ও ভেজাল খাদ্যের ব্যবসাই বুঝি জয়ী হচ্ছে। আসলে খাদ্যপণ্যে ভেজাল আমাদের জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণায় ঢাকা শহরের ৭০ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ৫০ শতাংশ খাদ্যে রাসায়নিক ও ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের ৩৩ শতাংশ রোগের মূল কারণ ভেজাল খাদ্য৷ মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া। এ সমস্যা শুধু মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করছে না বরং জাতীয় উন্নতিও বাধাগ্রস্ত করছে। কারণ খাদ্যে ভেজাল অসংখ্য জীবনঘাতী ও দীর্ঘস্থায়ী রোগের প্রাদুর্ভাব জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করছে। ভেজাল খাদ্যের কারণে ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ও হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি ইত্যাদি জটিল রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। উপরন্তু ভেজাল খাদ্যের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের যেসব সংস্থা বিভিন্ন অনুমতি দিয়ে থাকে, তাদের ঠিকমতো কাজ করতে হবে। যদি কোনো ক্রেতার কোনো খাবারকে অনিরাপদ মনে হয়, তবে তারা বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অফিসে সরাসরি এসে কিংবা ই-মেইলে অভিযোগ জানাতে পারে। তাছাড়া সংস্থাটির ওয়েবসাইটে দেয়া বিভিন্ন জেলার কর্মকর্তাদের ফোনেও অভিযোগ জানাতে পারবে। এজন্য সবচেয়ে বেশি দরকার আমাদের সচেতনতা। লেখকঃ মীর হোসেন মোল্লা(আরমান)/ সাংবাদিক।
Leave a Reply