রাসেল আদিত্য,স্পোর্টস ডেস্ক।।মেসি,নেইমার এবং সবশেষ এমবাপ্পে চলে যাওয়ার পর কোনো এক মহাতারকাকে ঘিরে পরিকল্পনা না সাঁজিয়ে,বরং দলগত ফুটবল খেলেই স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছে গেল প্যারিসের দলটি।চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে রেকর্ড ব্যবধানে জিতে ইউরোপ সেরার মুকুট পরল পিএসজি।
দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নকে সত্যি করতে, অধরা ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরতে কী দুর্দান্তভাবেই না জ্বলে উঠল পিএসজি! তাদের দ্যূতিময় আর দাপুটে পারফরম্যান্সের সামনে একেবারে ফিকে পড়ে গেল ইন্টার মিলান।ন্যূনতম চ্যালেঞ্জও জানাতে পারল না তারা। তিনবারের ইউরোপ চ্যাম্পিয়নদের রীতিমতো গোলবন্যায় ভাসিয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের আনন্দে ভাসল লুইস এনরিকের দল।
মিউনিখের আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় শনিবার রাতের শিরোপা লড়াইয়ে ৫-০ গোলে জিতেছে পিএসজি।ক্লাবের ৫৪হাদ বছরের ইতিহাসে এই অসাধারণ গল্প লেখার নায়ক যদি লুইস এনরিকে হন,তাহলে নিঃসন্দেহে মাঠের হিরো ১৯ বছর বয়সী দিজিরে দুয়ে।
প্রথমে আশরাফ হাকিমির গোলে ম্যাচের শুরুতেই এগিয়ে যাওয়ার পর দুই অর্ধে একটি করে গোল করেন তরুণ ফরাসি ফরোয়ার্ড দুয়ে।পরে বাকি দুটি গোল করেন খাভিচা কাভারাৎস্খেলিয়া ও সেনি।
ইউরোপের শীর্ষ প্রতিযোগিতার সুদীর্ঘ ইতিহাসে ফাইনালে এত বড় জয় আগে কোনো দল পায়নি।এর আগে সর্বোচ্চ ৪ গোলের ব্যবধান দেখা গিয়েছিল চারবার। ১৯৬০ সালে আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্টের বিপক্ষে রিয়াল মাদ্রিদ ৭-৩ গোলে,১৯৭৪ সালে আতলেতিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে বায়ার্ন মিউনিখ ৪-০ গোলে,১৯৮৯ সালে এফসিএসবির বিপক্ষে এসি মিলান ৪-০ গোলে এবং ১৯৯৪ সালে বার্সেলোনার বিপক্ষে এসি মিলান ৪-০ গোলের ব্যবধানে শিরোপা জিতেছিলো।
গতরাতের শিরোপা লড়াইটি কতটা একতরফা হয়েছে,তা স্কোরলাইনের পাশাপাশি বলছে পরিসংখ্যানও।ম্যাচে প্রায় ৬০ শতাংশ সময় বল দখলে রেখে পিএসজি গোলের জন্য ২৩ শট নিয়ে ৮ টি লক্ষ্যে রাখতে পারে।বিপরীতে ইন্টারের আট শটের দুটি ছিল লক্ষ্যে।যদিও সেগুলো তেমন ভীতি ছড়াতে পারেনি।
লুইস এনরিকের এই পিএসজি পজেশন ধরে রেখে খেলতে পছন্দ করে,যা তাদের কৌশলেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ।ফাইনালের মঞ্চে ইতিহাস গড়ার হাতছানিতেও তেমন কোনো স্নায়ুচাপে ভুগতে দেখা গেল না দলটিকে।বরং পরিকল্পনা অনুযায়ী অধিকাংশ সময় বল দখলে রেখে আক্রমণ শানাতে থাকে পিএসজি।আর তাতে সাফল্যও পেয়ে যায় চটজলদি। আট মিনিটের ভেতর দুই গোল করে ম্যাচের শুরুতেই চালকের আসনে উঠে বসে তারা।
খেলা শুরুর দশ মিনিটের মধ্যে তিনটি সাদামাটা প্রচেষ্টার পর দ্বাদশ মিনিটে সংঘবদ্ধ আক্রমণ থেকে গোল পেয়ে এগিয়ে যায় পিএসজি।ভিতিনিয়ার পাস ডি-বক্সে ধরে সামনে একপলকে দিজিরে দুয়ে দেখলেন গোলরক্ষক তার দিকে এগিয়ে আছে,ত্বরিত সিদ্ধান্ত বদলে তিনি পাস বাড়ালেন অন্য পাশে হাকিমিকে। ফাঁকায় বল পেয়ে বিনা বাধায় বল জালে জড়িয়ে দেন গেলো বিশ্বকাপে বলো ছড়ানোনমরক্কোর এই রাইট-ব্যাক।
অথচ এতো বড় মঞ্চে দলকে এমন দুর্দান্ত শুরু এনে দিয়েও কোনোরকম উদযাপন করেননি হাকিমি।কারন ২০২০-২১ মৌসুমে ইতালিয়ান দলটিতে খেলেছেন তিনি।উল্টো গোল করার অপরাধে ইন্টার সমর্থকদের দিকে তাকে দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে দেখা যায়।
আট মিনিট পর তথা ম্যাচের ২০ মিনিটে কিছুটা সৌভাগ্যের ছোঁয়ায় ব্যবধান দ্বিগুণ করে পিএসজি।গোল পরিশোধে মরিয়া ইন্টারের একটি আক্রমণ রুখে দিয়ে তড়িৎ পাল্টা আক্রমণে ওঠে তারা।হাকিমি এবসর ঋন শোধ করতে পাস বাড়ান ডি-বক্সে উঠে আসা দিজিরে দুয়েকে।বল পেয়ে শট নেন ১৯ বছর বয়সী দুয়ে, সামনে ডিফেন্ডার ফেদেরিকো ডি মার্কোর পায়ে লেগে দিক পাল্টে বল জড়িয়ে যায় জালে।অথচ দুয়ের শট বাঁধা না পেলে গোলরক্ষকের হাতেই যেতো।এই গোলের সঙ্গে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেন দুয়ে।১৯ বছর ৩৬২ দিন বয়সে তৃতীয় টিনএজার হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে গোল করলেন তিনি।আগের দুজন হলেন প্যাট্রিক ক্লুইভার্ট ও কার্লোস আলবের্তো।২-০ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় পিএসজি।
বিরতির পরও একইরকম দাপুটে শুরু করে পিএসজি।এই অর্ধের প্রথম সাত মিনিটে আরও তিনটি শট নেয় তাঁরা, যদিও একটিও লক্ষ্যে ছিল না।পক্ষান্তরে
সেমিফাইনালের দুই লেগে বার্সেলোনার বিপক্ষে দুই মহাকাব্যিক লড়াইয়ের পর ফাইনালে উঠে আসা ইন্টার মিলান ফাইনালের মন্চে কেমন নিষ্প্রভ হয়ে থাকলো।
খেলার ৬৩ মিনিটে আরেকটি দুর্দান্ত গোল করে ইন্টারের ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায় শেষ করে দেয় পিএসজি।আরেকটি গতিময় আক্রমন থেকে ভিতিনিয়ার থ্রু পাস ডি-বক্সে পেয়ে নিখুঁত শটে নিজের দ্বিতীয় ও খেলার তৃতীয় গোলটি করেন ম্যাচ সেরা দুয়ে।৩-০ গোলে এগিয়ে যাওয়া পিএসজি সাপোর্টাররা শিরোপা জয়ের উৎসব শুরু করে দেয়।
।
তৃতীয় গোলের ১০ মিনিট পর তথা খেলার ৭৩ মিনিটে মাঝমাঠ থেকে উসমান দেম্বেলের থ্রু পাস ধরে অসাধারন ক্ষিপ্রতায় ডি-বক্সে ঢুকে নিচু শটে ইন্টার গোলরক্ষককে পরাস্ত করেন জর্জিয়ার ফরোয়ার্ড কাভারাৎস্খেলিয়া।৪-০ গোলে এগিয়ে যায় পিএসজি
ওই গোলের পর কোচ এনরিকের উচ্ছ্বাস, সাইড লাইন ধরে তাঁর ছুটে যাওয়া ছিল দেখার মতো।বার্সেলোনার হয়ে ২০১৪-১৫ মৌসুমেও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছিলেন তিনি।কিন্তু প্রতিযোগিতাটির ফাইনালের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বকনিষ্ট দল নিয়ে এমন সাফল্য অবিশ্বাস্যই বটে।
তাদের গোল উৎসবের তখনও অবশ্য বাকি। ৮৪তম মিনিটে ফাবিয়ান রুইসের বদলি নামার দুই মিনিট পরই জালের দেখা পেয়ে যান আরেক ১৯ বছর বয়সী ফরাসি সেনি।দুরূহ কোণ থেকে জোরাল শটে ইন্টার গোলরক্ষক ইয়ান সমেরকে পরাস্ত করেন ফরাসি মিডফিল্ডার।৫-০ গোলের অবিশ্বাস্য লিড নেয় পিএসজি।
অথচ,প্রাথমিক পর্বের প্রথম পাঁচ রাউন্ডে মাত্র একটিতে জিতে (বাকি চার ম্যাচের তিনটিতে হার ও একটি ড্র) এই পিএসজিই চলে গিয়েছিল বিদায়ের দুয়ারে।সেখান থেকে টানা তিন ম্যাচ জিতে প্লে-অফে জায়গা করে নেয় তাঁরা। এরপর কেবলই এগিয়ে চলা।যার শেষ হলো শিরোপা জেতার মধ্য দিয়ে।
Leave a Reply