চৌদ্দগ্রাম (কুমিল্লা) প্রতিনিধি :
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ঠিকাদারের অবহেলায় গুরুত্বপূর্ণ নানকরা-দুর্গাপুর সড়কের নির্মাণকাজ নির্দিষ্ট সময়সীমার দুই বছরেও শেষ হয়নি। এতে করে ব্যাপক দুর্ভোগের স্বীকার হচ্ছেন সাধারন মানুষ। বর্তমান বর্ষা মৌসুমে সড়কের বিভিন্ন অংশে খানা-খন্দ ও গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় যানচলাচলও ব্যাহত হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে নির্মাণ কাজ শেষ না করায় জনদুর্ভোগ ও চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে উপজেলা প্রকৌশলীর দপ্তর হতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর কাজ বাতিলের একাধিকার চিঠি দিলেও বারবার তা ঠেকিয়ে দেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ফাতেমা ট্রেডার্সের স্বত্বাধীকারী আ’লীগ নেতা অলি আহমেদ মজুমদার।
জানা যায়, বিগত সরকারের সময়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের সহযোগীতায় বড় বড় প্রকল্পের কাজ ভাগিয়ে নিতেন অলি আহমেদ। দলীয় পরিচয়ের কারণে সড়ক নির্মাণ, স্কুল ভবন নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম করেও পার পেতেন তিনি। আগষ্ট পরবর্তী সময়েও এই ঠিকাদারের ক্ষমতা দেখে চৌদ্দগ্রামের নানান মহলে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। বিতর্কিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ফাতেমা ট্রেডার্স ও তাদের অপর প্রতিষ্ঠান রাজিয়া এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে উপজেলার আরও একাধিক সড়ক নির্মাণেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নানকরা দুর্গাপুর সড়ক ছাড়াও আরও অন্তত ৪টি সড়কের নির্মাণ কাজ বন্ধ রেখে উপজেলার উন্নয়নকে বাঁধাগ্রস্থ করছেন এই ঠিকাদার। সাধারন মানুষ কিংবা সংশ্লিষ্ট দপ্তর তাদের লাইসেন্সের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দিলে সদর দপ্তরে তার লোক আছে, তার লাইসেন্সের কোন ক্ষতি হবে না। এভাবে বাপ ছেলের কাছে পুরো উপজেলাবাসী জিম্মি হয়ে আছে।
জানা যায়, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে গ্রামীন সড়ক মেরামত ও সংরক্ষণ কর্মসূচীর আওতায় চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ৫ কি:মি: দৈর্ঘ্যরে নানকরা-দুর্গাপুর সড়কের টেন্ডার ঘোষনা করে এলজিইডি। ৪কোটি ২৯লক্ষ ৯১হাজার টাকা মূল্যের কাজটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফাতেমা ট্রেডার্স ২০২৩ সালের ২৯শে অক্টোবর শুরু এবং ২০২৪ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজটি শুরুই করেনি ঠিকাদার। সংশ্লিষ্ট কাজটির তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপ-সহকারী প্রকৌশলী পলাশ চন্দ্র রায় একাধিকবার কাজটি শেষ করার মৌখিক নির্দেশনা দেন এবং পরে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা প্রকৌশলী মোঃ নুরুজ্জামান মৌখিক ও পরবর্তীতে কয়েকবার লিখিত নির্দেশনা দিলে ঠিকাদার সড়কটির কোন মতে হার্ডবেড শেষ করে আবারো কাজ বন্ধ রাখেন।
উপজেলা প্রকৌশল অফিস সূত্রে আরো জানা যায়, নানকরা-দুর্গাপুর সড়কের নির্মাণকাজের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে মৌখিক চাপ ও লিখিত চিঠিকেও ঠিকাদার তোয়াক্কা করেনি। ৫ই আগষ্টের পরবর্তী সময়েও কাজটির টেন্ডার বাতিলের জন্য দুইবার চিঠি প্রদান করা হলেও কাজটি বাতিল হচ্ছেনা।
একই প্রকল্প অর্থাৎ এঙই গধরহঃবহধহপব এর আওতায় ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৩.৩ কিমি দৈর্ঘ্যরে মিয়া বাজার-বালুমুরি রাস্তার কাজ নেন বিতর্কিত ঠিকাদার অলি আহমেদের প্রতিষ্ঠান ফাতেমা ট্রেডার্স। ঐ অর্থবছরেই কাজটি শেষ করার বাধ্যবাধকতা থাকা স্বত্বেও একই প্রক্রিয়ায় কাজটি দু-বছরে শেষ করেননি তিনি।
উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সড়ক “বাহেরগড়া-শুভপুর” সড়ক নির্মাণে নি¤œমানের খোয়া, ইট ব্যবহারের অভিযোগ উঠে অলি আহমেদ মজুমদারের মালিকানাধীন বিতর্কিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ফাতেমা ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে স্থানীয়রা সড়কটির একাংশের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। ১ কোটি ৫৫ লাখ ৪১ হাজার ৬৪১ টাকার দুই হাজার দশ মিটার দৈর্ঘ্যরে সড়কটিও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারেনি তিনি। পরে ৩ মাস সময় বাড়িয়ে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা করেন ঠিকাদার অলি আহমেদ। সড়কটিতে নি¤œমানের খোয়া ও সোল্ডারে মাটি না দেয়ার অভিযোগে চলতি বছরের গত ১৬ জানুয়ারী এলজিইডির উপ-সহকারী প্রকৌশলী পলাশ চন্দ্র রায় প্রদত্ত পরিদর্শন রিপোর্টের আলোকে নতুনভাবে নির্মাণ এবং সোল্ডারে মাটি প্রদানের নির্দেশনা দিলেও তার তোয়াক্কা না করে নির্মাণ শেষ করেন।
উপজেলার ঘোলপাশা ইউনিয়নের ৮.১১ মিটার বাবুর্চি বাজার সড়ক। ৭৬ লাখ ৯৯ হাজার ৬৬৯ টাকায় কাজটি পায় ফাতেমা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী অলি আহমেদ মজুমদারের ছেলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রাজিয়া ট্রেডার্স। ২০২৪ সালের জুন মাসের ৪ তারিখে শুরু করে একই বছরের অক্টোবরের ৩ তারিখে কাজ শেষ না করে নভেম্বরের ৭ তারিখ পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না করায় এবং সড়কটি খোড়াখুড়ি করে যান ও মানুষ চলাচল অনুপযোগী হওয়ায় ব্যাপক দুর্ভোগের স্বীকার হয় ঐ এলাকার মানুষ। জনদুর্ভোগ লাগবে স্থানীয়রা তৎকালীন সময়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর চিঠি প্রদান করেন। এ কাজটিরও চুক্তি বাতিলের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি প্রদান করেন উপজেলা প্রকৌশলী।
১ কি. মি. দৈর্ঘ্যরে উজিরপুর ইউনিয়নের আশ্রাফপুর-কোমারডোগা সড়কের কাজটি পায় ফাতেমা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী অলি আহমেদ মজুমদারের ছেলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রাজিয়া ট্রেডার্স। কাজের মেয়াদ ডিসেম্বর ২০২৩ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৪ হলেও এরপর এক বছর পার হলেও এখনো কাজটি না করে জনগনের দুর্ভোগ বাড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি।
উপজেলার আরেক গুরুত্বপূর্ণ সড়ক মিরশানি বাজার-সোনাপুর সড়কের কাজটি পায় মেসার্স রাজিয়া ট্রেডার্স। কাজের মেয়াদ জানুয়ারি ২০২৪ থেকে অক্টোবর ২০২৪ হলেও এরপর প্রায় এক বছর পার হলেও এখনো কাজটি শেষ হয়নি।
ফাতেমা ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী ঠিকাদার অলি আহমেদ অভিযোগের বিষয়ে জানান, বিগত সরকারের সময়ে নানকরা-দূর্গাপুর সড়কের কাজটি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে দিই। নানকরা-দুর্গাপুর সড়কটির টেন্ডার বাতিলের চিঠি ঠেকিয়ে দেয়ার বিষয়টি সত্য নয় বলে তিনি জানান। বর্ষার কারণে কাজগুলো সময়ে করা যাচ্ছেনা। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে নানকরা-দুর্গাপুরসহ চৌদ্দগ্রামের সকল পেন্ডিং কাজগুলো শেষ করা হবে।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা প্রকৌশলী মোঃ নুরুজ্জামান জানান, সময়ের মধ্যে কাজ শুরু ও শেষ করার জন্য উপজেলা দপ্তর থেকে শুরুতেই ঠিকাদারদের লে-আউট/ সাইট বুঝিয়ে দেয়া হয়। কাজ চলমান অবস্থায় কাজের মান নিয়ন্ত্রণে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হয়। তথাপি উল্লেখিত ঠিকাদারের সময়ের মশ্যে কাজ শেষ না করার জন্য কাজগুলো বাতিলের সুপারিশ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠানো হয়েছে।
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জামাল হোসেন বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটির অনিয়মের কারণে আমরা একাধিকবার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এলজিইডি কুমিল্লা জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল মতিন জানান, নানকরা-দুর্গাপুর সড়কটির টেন্ডার বাতিলের জন্য জেলা থেকেও চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু ঠিকাদার কাজটি শেষ করবে বলে হেড অফিস থেকে নতুন করে চিঠি নিয়ে আসে। চলতি বছরে নতুন করে কাজটি অনুমোদন নেয়া হয়নি। সে হিসেবে কাজটি বাতিল হওয়ার কথা। ঠিকাদারের আরও পেন্ডিং কাজের বিষয়ে আমি সংশ্লিষ্ট উপজেলায় খবর নিচ্ছি। এমন কিছু হলে লাইসেন্সটির বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি পাঠানো হবে।
Leave a Reply