কুমারখালী (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধিঃ কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার নন্দলালপুর ইউনিয়নের সোন্দাহ গ্রাম, যা একসময় হস্ত চালিত তাঁত শিল্পের জন্য সুপরিচিত থাকলেও এখন নীরবতা বিরাজ করছে । ১৪শত তাঁতি পরিবারের এই গ্রামটিতে একসময় প্রতিটি বাড়িতেই ছিল ৩ থেকে ৪টি করে তাঁত । সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাঁতের খটখটি শব্দে মুখরিত থাকত পুরো গ্রাম । তবে কালের বিবর্তনে, সুতা সহ দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দামের কারণে ঐতিহ্যবাহী এই তাঁত শিল্প এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে । তাঁতের খটখটি শব্দে মুখরিত গ্রামটিতে এখন ৪ থেকে ৫ বাড়ি পর পর দেখা মিলছে ১ টি করে তাঁত । আর্থিক অনটনের কারণে বহু তাঁতি তাদের পৈতৃক এই পেশা ছেড়ে রাজমিস্ত্রীর কাজ, ভ্যান চালানো সহ বিভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন । অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, একজন তাঁতি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করে দিনে আয় করছেন ১০০ থেকে ১৫০ টাকা ।
সোন্দাহ গ্রামের তাঁতিদের সাথে কথা বলে জানা যায় , সুতা সহ অন্যান্য দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির কারণে নিজেদের পুঁজি হারিয়ে বর্তমানে মহাজনের পুঁজিতে লুঙ্গি, গামছা ও রুমাল তৈরি করছেন তারা । মহাজনের দেওয়া বিম ও সুতা নিয়ে কাজ করে প্রতি হাত লুঙ্গি, গামছা অথবা রুমাল তৈরি করে পাচ্ছেন ৫ টাকা । প্রতিদিন ৩০ হাত লুঙ্গি, গামছা অথবা রুমাল বুনে আয় করেন ১০০ থেকে ১৫০ টাকা । কেউ কেউ সপ্তাহে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকাও আয় করে থাকেন । দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে স্বল্প আয়ে সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে তাদের । নিম্ন আয়ে সংসার চালাতে না পেরে অনেকেই এক প্রকার বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন পৈতৃক এই পেশা ।
তাঁত শ্রমিক টিপু সুলতান জানান, ছোট থেকেই তিনি তাঁতের কাজ করছেন । ভোর থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করে আয় করেন ১০০ থেকে ১৫০ টাকা । অপরদিকে তার স্ত্রী নলিতে সুতা ভরে দিনে আয় করেন ৩০ থেকে ৫০ টাকা । আগে এই কাজ করে ভালোমত সংসার চালাতে পারলেও বর্তমানে কোন রকম খেয়ে পড়ে জীবনযাপন করছেন তারা । ছোটবেলা থেকেই তিনি তাঁতের কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় এখন অন্য কোন কাজ করতে পারেন না বলে জানান তিনি ।
আরেকজন তাঁত শ্রমিক রবিউল ইসলাম জানান, সোন্দাহ গ্রামের প্রতিটা বাড়িতে একসময় ৩ থেকে ৪ টা করে তাঁত থাকলে এখন আর তা নেই । সুতা সহ অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে অনেকেই পুঁজি হারিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন । সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তাঁতের কাজে ব্যস্ত থাকা গ্রামটিতে এখন ৫০টি তাঁত খুজে পাওয়া যাবে না ।
তিনি আরও জানান, অন্যান্য পেশায় দিনে ৫০০ টাকা আয় হলেও তাঁতিরা দিনে আয় করেন ১০০ থেকে ১৫০ টাকা । তাদের তৈরি গামছা, লুঙ্গি, রুমাল বাজারে চড়া দামে বিক্রি হলেও তারা ন্যায্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না । সুতা ও অন্যান্য উপকরণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, উৎপাদিত বস্ত্রের ন্যায্য দাম না পাওয়া এবং আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিতে না পারায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী হস্ত চালিত তাঁত শিল্প । সরকারি সহযোগিতা এবং সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা পেলে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব মন্তব্য করেন তিনি ।
কুমারখালী বিসিক শিল্পের এজিএম মেহেদী হাসান জানান, ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকার তাঁতিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সহ ৫% মুনাফায় ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদান করেন । ইতি মধ্যে অনেকে ঋণ পেয়েছেন এবং আগামীতে সরকারীভাবে তাঁতিরা সহজ শর্তে রং, সুতা সহ নানা উপকরণ পাবেন বলে জানান তিনি ।
Leave a Reply