মীর হোসেন মোল্লাঃ জব্বারের বলীখেলাকে কেন্দ্র করে ২৪, ২৫ এবং ২৬ এপ্রিল এই তিনদিন বসে বৈশাখী মেলা। বলী খেলা হয় ১২ বৈশাখ। তবে গত কয়দিন থেকেই মেলার দোকানীরা আসতে শুরু করেছে। নগরীর আন্দরকিল্লা থেকে কোতোয়ালী মোড় পর্যন্ত ফুটপাতে গত তিন দিন ধরেই মেলার দোকানীরা অবস্থান নিয়েছে। তবে আজ থেকে যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে মেলা শুরু হবে তাই গতকাল থেকেই পণ্য উন্মুক্ত করেছে।
ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলী খেলার ১১৬তম আসর শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) বিকেল চারটায়। তৈরি হয়েছে বালুর মঞ্চ। বলীদের থাকার ব্যবস্থা করেছে সিটি করপোরেশন। মেলার পৃষ্ঠপোষক গ্রামীণফোন।
বলীখেলার মূল পর্বের উদ্বোধন করবেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাসিব আজিজ। বিজয়ী বলীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
জব্বারের বলীখেলাকে ঘিরে লালদীঘির পাড়ে শুরু হলো এ জনপদের সবচেয়ে বড় লোকজ মেলা। বরিশাল ও সিলেটের শীতলপাটি থেকে শুরু করে ঢাকার পোড়ামাটির মৃৎশিল্প সামগ্রী কী নেই এ মেলায়।
প্রতিবছরের মতো বেশি বিক্রি হচ্ছে ফুলের ঝাড়ু আর হাতপাখা।
শিশুদের টমটম গাড়িসহ নানান খেলনা, মেয়েদের শাড়ি, চুড়ি, গহনা, গাছের চারা, মৌসুমি ফলমূল, শোপিস, লোহা-বাঁশ-বেতের তৈরি সংসারের টুকিটাকি, জাল, চাঁই, ডালা, কুলাসহ কৃষি উপকরণ, মুড়িমুড়কিও পাওয়া যাচ্ছে এ মেলায়।
মাটির ব্যাংক, ফুলদানি, টব, পানির জার, কলস, ধর্মীয় উপকরণ, জগ, গ্লাস, চায়ের কাপ, পাতিলের চাহিদা ও দাম দুটোই বেশি। দর কষাকষি করে চলছে বিকিকিনি। কারিগররা ব্যস্ত ফুলদানি, টব ও ব্যাংকে রং করার কাজে।
লালদীঘি পেট্রল পাম্প সোনালি রঙের প্রলেপ দিচ্ছিলেন গাজীপুর সমীরণ পাল। তিনি বলেন, মৃৎশিল্পে আধুনিক ডাইস, চুল্লি, নকশার ব্যবহার বাড়ায় ধনীদের কাছে মাটির তৈরি পণ্যের কদর বাড়ছে। বিদেশিরাও বেশ কৌতূহলী।
সাভারের নবীনগর থেকে ৪০ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে দুই ট্রাক পোড়ামাটির জিনিস এনেছেন সহদেব পাল। তিনি বলেন, এবার কালবৈশাখী ঝড়ের শঙ্কা আছে। কেমন বিক্রি হবে জানি না।
কিছু পণ্য নির্দিষ্ট জায়গায় মিললেও ফুলের ঝাড়ু আর হাতপাখা পাওয়া যাচ্ছে পুরো মেলায়। কারাগারের ফটকের পাশে বাঁশখালী থেকে ফুলের ঝাড়ু নিয়ে এসেছেন ৬-৭ জন। বৃদ্ধ আজিজ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ভালোমানের ফুলের শলা দিয়ে বেতের বাঁধাই করা একজোড়া ঝাড়ু ৪০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। কমদামি এমনকি প্লাস্টিকের ঝাড়ুও বিক্রি হচ্ছে মেলায়।
দেশে তালপাতা, বাঁশ, বেত, কাপড়, প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি প্রায় সব ধরনের হাতপাখা পাওয়া যাচ্ছে মেলায়।
কোতোয়ালী মোড় থেকে সিনেমা প্যালেস, আন্দরকিল্লা, লালদীঘির চার পাড়সহ আশপাশের এক বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়েই আকর্ষণীয় সব পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিভিন্ন জেলার দোকানিরা। বেপারী, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উদ্যোক্তা, গৃহস্থ, মৌসুমি দোকানি, কামার, কুমোরের বাইরে বিপুল সংখ্যক নারী চুড়ি, গহনা, খেলনা বিক্রি করছেন মেলায়।
পুরাতন গির্জা এলাকায় এক হাজার পিস টমটম গাড়ি নিয়ে বসেছেন আলাউদ্দিন মিয়া। তিনি বলেন, এ গাড়ি মেলার ঐতিহ্য। বাপদাদার বংশ পরম্পরায় মেলায় মেলায় ফেরি করি টমটম। গরিবরা প্লাস্টিকের খেলনার দিকে ঝুঁকলেও শিক্ষিতরা শখের বসে কিংবা সন্তানকে টমটমের সঙ্গে পরিচিত করাতে কিনছেন।
বরিশালের শীতলপাটি নিয়ে এসেছেন বিপ্লব দাশ৷ তিনি বলেন, পাঁচ ফুট সাত ফুটের রঙিন নকশার পাটি সাড়ে তিন হাজার টাকা। বেডশিট ও প্লাস্টিকের মাদুরের কারণে পাটির চাহিদা কমছে বলে জানান তিনি।
লালদীঘির উত্তর পাড়ে বসেছে চারার হাট। আম্রপালি, ব্যানানা, লাল মিয়াজাকি বা সূর্য ডিম্ব আম, লেবু, অড়বরই, লটকন, জাম্বুরা, জামরুল, গোলাপজাম ধরে আছে টবের ছোট্ট ছোট্ট গাছে। বর্ণিল ফুল ফুটে আছে। পাতাবাহার শোভা বাড়াচ্ছে। ফলদ, বনজ, ঔষধি গাছের চারা কিনছেন বৃক্ষপ্রেমীরা। লাল সূর্য ডিম জাতের এক ডজন আমসহসহ হাফ ড্রামে লাগানো গাছের দাম হাঁকা হচ্ছে ৫ হাজার টাকা।
ভোরে সপরিবারে মেলায় এসেছেন মোহাম্মদ ইউসুফ। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের মানুষ এক বছর অপেক্ষা করে এ মেলার জন্য। কিন্তু জৌলুশ হারাচ্ছে। সুব্যবস্থাপনা, সহযোগিতা না পাওয়ায় বিক্রেতারা আগ্রহ হারাচ্ছেন। তারপরও কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয় এ মেলায়। তাই নীরবে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, পকেটমার, ইভটিজিং চলে৷ নারীদের উচিত সকালে কিংবা মধ্য রাতে মেলায় আসা৷
বলীখেলা আয়োজক কমিটির সদস্যসচিব, আবদুল জব্বার সওদাগরের নাতি শওকত আনোয়ার বাদল জানিয়েছেন, বলীখেলার কমিটি কোনো স্টলমালিক বা বিক্রেতার কাছ থেকে চাঁদা বা ভাড়া নিচ্ছে না। যদি কেউ চাঁদাবাজি করে পুলিশকে সোপর্দ করে দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
Leave a Reply