মুহাম্মাদ রবিউল মুন্সীঃ ১২৬ বছর আগের এই দিনে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির আকাশে উদিত হয়েছিল এক দীপ্তিমান নক্ষত্র—জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সময়কে অতিক্রম করে আজও যিনি প্রাসঙ্গিক, জীবন্ত এবং প্রেরণার উৎস। এবারের নজরুলজয়ন্তীতে সেই চিরন্তন কবিকে নতুন করে উপলব্ধি করার প্রয়াসে প্রকাশ পেয়েছে একটি শিল্পচিত্র, যা নজরুলের আদর্শ ও দর্শনকে চিত্ররূপে প্রকাশ করেছে।
সাধারণ দর্শনে ছবিটি নিঃশব্দ, সংযত এবং গাম্ভীর্যপূর্ণ। নজরুলের চোখে এক গভীর নিরবতা—যেন শত শত শব্দ সেখানে অটলভাবে জমে আছে। মাথায় সাদা টুপি, পরনে সাদাসিধে পোশাক, মুখভঙ্গিতে দৃঢ়তা আর দৃষ্টিতে স্পষ্ট এক বিপ্লবের বার্তা। এই প্রতিচ্ছবি যেন সেই বিদ্রোহী কবির, যিনি শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে এককভাবেই কলম হাতে নেমেছিলেন সংগ্রামে।
পেছনের পটভূমি সেপিয়া রঙে আঁকা। রঙের এই বেছে নেওয়া মাধ্যম অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয়, কিন্তু সেই অতীত কখনও মৃত নয়। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ রচনা করে এবং স্মরণ করায় যে, নজরুল কেবল ইতিহাসের চরিত্র নন—তিনি আজকের সমাজেরও দর্পণ।
চিত্রটিতে নজরুলকে ঘিরে কোনো চমকপ্রদ ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। বরং আছে এক ধরণের ঋজুতা ও আত্মমর্যাদা, যা তার জীবনবোধের প্রতিচ্ছবি। এই ছবিতে কোনো শিরস্ত্রাণ নেই, নেই কোনো সিংহাসন বা বিজয়ের নিশান—কিন্তু রয়েছে এক অদৃশ্য শক্তি, যেটি অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে শেখায়।
এই চিত্রকর্ম আমাদের কাছে শুধু নজরুলের মুখচ্ছবি নয়; এটি তার জীবনের আদর্শ, তার কলমের শক্তি এবং তার সময়ভেদী বার্তার এক রূপান্তর। নজরুল জয়ন্তীতে এমন একটি শিল্পচর্চা প্রমাণ করে যে, আজও আমরা তাঁর দর্শনে ফিরে যেতে চাই, তাঁকে নতুন করে বুঝতে চাই।
সময়ের পরিক্রমায় নজরুলকে আমরা নানা ভাবে স্মরণ করেছি—কখনো পাঠ্যবইয়ে, কখনো মঞ্চে, কখনো কণ্ঠে গানে। কিন্তু এবার একটি চিত্রশিল্পের মধ্য দিয়ে নজরুল যেন আরও একবার তাঁর চেতনায় আমাদের আহ্বান জানাচ্ছেন—জেগে উঠো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াও, সত্যের পথে হাঁটো।
চিত্রের নীরবতাই নজরুলের শক্তি। তিনি কোনো উচ্চারিত শব্দের বাহক নন, বরং তিনি এক গভীর নিঃশব্দ প্রতিরোধ। তাঁর মুখে ভাষা নেই, কিন্তু দৃষ্টিতে বিস্ফোরণ। এই ছবির দিকে তাকিয়ে আমরা শুধু তাঁর মুখ নয়—দেখতে পাই আমাদের দায়িত্ব, আমাদের লড়াই, আমাদের পথচলা।
নজরুল জয়ন্তীতে এমন এক শিল্প উপস্থাপন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আদর্শ কখনো পুরোনো হয় না। তিনি আমাদের সময়ের বাইরের কবি, কিন্তু আমাদের সময়ের গভীর প্রয়োজন। এই শিল্পচিত্র সেই প্রয়োজনের এক নিঃশব্দ, কিন্তু দৃপ্ত উচ্চারণ।
Leave a Reply